আজ || শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
শিরোনাম :
 


সাতক্ষীরায় শ্রমজীবী শিশুদের সুরক্ষার পাশাপাশি তাদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে ‘উত্তরণ’

কখনো বিপদজনক শ্রম চিংড়ী, কখনো কাঁকড়া ও কখনো বিভিন্ন ধরণের মাছ ধরাসহ কঠোর পরিশ্রমের সাথে জড়িত হয়ে পড়েছে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার শিশুরা। দারিদ্রের যাতাকলে নিষ্পেষিত এসব শিশুর জীবন। শিক্ষা যেখানে আমাবশ্যার চাঁদ। দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের সন্ধানে নিয়মিত যাদের নিয়ে যায় বিপদজনক শ্রমে। শিশু সুরক্ষার কথা ওরা জানে না, অধিকারের বার্তা ওদের কাছে অর্থহীন। খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই জীবনের সার কথা। শৈশব থেকেই শুরু হয় বিবর্ণ কর্মজীবনের সূচনা। যেখানে জন্ম থেকেই ঘৃণা আর অবহেলায় বেড়ে ওঠে এসব শিশুরা। অপরিণত বয়সেই বিয়ে, অতঃপর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে মা ও শিশু। দুর্যোগ ঝুঁকি যাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। উপকূলীয় প্রান্তিক শিশুদের অন্তহীন দুর্দশার কথা বিবেচনা করে তাদেরকে শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত করার পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য খাতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের সুরক্ষার জন্য এগিয়ে আসে বে-সরকারী উন্নয়ন সংস্থা উত্তরণ। উত্তরণের এডুকো-Educo (Prevention and Elimination of Hazardous From of child labor in Costral Areas of Bangladesh) প্রকল্পের বাস্তবায়নে এবং এডুকো বাংলাদেশ-এর অর্থায়নে বিপদজনক শ্রম চিংড়ী, কাঁকড়া ও মাছ ধরার কাজে জড়িত শিশুদের শিক্ষার আলো ছড়াতে কাজ করছে সংস্থাটি। শ্যামনগর উপজেলায় মুন্সিগঞ্জ, বুড়িগোয়ালিনি, গাবুরা ও কাশিমাড়ী ইউনিয়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই চার টি ইউনিয়নের চারটি লার্নিং সেন্টারে ৩৫০ জন শ্রমজীবী শিশুকে শিক্ষাদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই শিশুরা নিয়মিত লার্নিং সেন্টারে এসে লেখাপড়া করছে এবং এরমধ্য থেকে ২৫ জন ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সুইং মেশিন ও টেইলরিং এবং ২৫ জন ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের বিষয়ে তিন মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। ইতিমধ্যে এই সকল শ্রমজীবী শিশুদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও সুযোগ বৃদ্ধির জন্য শিশুদেরকে নিয়ে বিশ^ শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
শ্যামনগর উপজেলার উপকূলের প্রান্তিক জনপদ ঘুরে জানা গেছে, শিশুদের যেখানে হাসি-খুশি ও আনন্দ-উল্লাসে বেড়ে ওঠার কথা, সেখানে শুধুই দারিদ্রের কষাঘাত। অনিশ্চয়তায় বিবর্ণ হয়ে ওঠে উপকূলের হাজারো শিশুর শৈশব। বিপদজনক শিশুশ্রমের বেড়াজালে বন্দিজীবন কাটে তাদের। যেখানে শিশুর হাতে থাকার কথা বই, সেখানে কোমলমতি শিশুদের কাঁধে ওঠে সংসারের বোঝা। যে চোখে স্বপ্ন দেখার কথা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের, সেই চোখ নির্ঘুম রাত জাগে মৎস্য ও কাঁকড়া আহরণের প্রয়োজনে। নৌকা আর জাল নিয়ে ছুটতে হয় মৎস্য শিকারে, অনেক সময় যেতে হয় গভীর জঙ্গলে। শুধু মৎস্য কিংবা কাঁকড়া আহরণ নয়, কর্মের সর্বক্ষেত্রে এদের সমান পদচারণা।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামে উত্তরণের শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, লেখাপড়ায় ব্যস্ত রয়েছে ৩৫ থেকে ৪০ জন শিশু। আছমা খাতুন নামের একজন শিক্ষিকা তাদেরকে পাঠদান করাচ্ছেন। গ্রামের ভাড়া করা ছন-বাঁশ-টিনের স্কুল ঘরগুলোর কাঁচা মেঝেতেই শিশুরা সুশৃঙ্খলভাবে ক্লাস করছে। শিশুকেন্দ্র গুলোর শিক্ষার মান এবং অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সুন্দর আচরণে যে কেউ মুগ্ধ হবে।
এ শিখন কেন্দ্রের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফয়সাল শেখ, নয়ন মন্ডল, তাইজুল সরদার, ফুলঝুরি, সীমা বারুই, সোনামনি সরদারসহ কয়েকজন জানায়, শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে পড়তে তাদের ভালো লাগে। কারণ বিভিন্ন কাজ করার পাশাপাশি তারা এখানে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছে। উপকূলীয় এলাকার এই শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম থেকে মুক্ত করে শিখন কেন্দ্রে পড়াতে পেরে স্থানীয়দের মাঝেও উৎসাহ দেখা যায়।
ঐ কেন্দ্রের শিক্ষিকা আছমা খাতুন জানান, প্রতিদিন সকাল এবং বিকাল দুই শিফটে ২ জন শিক্ষক মিলে দু’টি ক্লাস নেয়া হয়। স্থানীয় শিশু সুরক্ষা কমিটি ও অভিভাবকগণ শিশুদের মূল্যায়ন দেখতে আসেন এবং খোঁজ-খবর নেন। উক্ত কার্যক্রম বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনসহ কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষ সম্পৃক্ত রয়েছে বলে জানান তিনি।
উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের টেকনিক্যাল অফিসার অলোক পাল জানান, প্রকল্পের আওতায় ৫-১৭ বছর বয়সী চিংড়ি, কাঁকড়া ও মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুদের নিয়ে শ্যামনগর দুর্গম এলাকায় এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চলতি বছরের শুরুতেই অত্র প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয় কিন্তু জানুয়ারী ২০২১ থেকে বিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও করোনাকালীন সময়ে সরকারী নির্দেশনা মোতাবেক সকল বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সেপ্টেম্বর মাসে অত্র উপজেলায় ৪টি ইউনিয়নে ৪টি শিক্ষা কেন্দ্রের মাধ্যমে ৩৫০ জন শিশুকে নিয়ে শিশুকেন্দ্রের কার্যক্রম চালু হয়েছে। এই ৩৫০ জন শিশুর মধ্য থেকে ১৪-১৭ বছর বয়সের উপরের ২৫ জন শিশুকে ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সুইং মেশিন ও টেইলরিং এবং ২৫ জনকে ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসির্ং প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এখানে সকল শিক্ষার্থী কাজের পাশাপাশি তাদের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে। এছাড়া প্রতিটি ইউনিয়নে জনপ্রতিনিধি, অভিভাবক মিলে একটি ২১ সদস্য বিশিষ্ট শিশু সুরক্ষা কমিটি রয়েছে। তারা শিক্ষা কেন্দ্রর ব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক বিষয় তদারকি করে থাকেন।
উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাজমা আক্তার বলেন, শ্যামনগরের মুন্সীগঞ্জ, কাশিমাড়ি, বুড়িগোয়ালিনী ও গাবুরা ইউনিয়নের চার গ্রামে ৪ টি শিশুকেন্দ্র পরিচালনা হচ্ছে। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হ্রাস করা বিশেষ করে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মৎস্য খাতে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের সুরক্ষা দেয়া।
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমে ওয়ার্ডভিত্তিক জরিপ করে খুঁজে বের করার চেষ্টা করি ৫-১৭ বছর বয়সী ঝুঁকিপূর্ণ চিংড়ি, কাঁকড়া ও মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রমের শিশুদের ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর হার কেমন। আর্থিক অসচ্ছলতা, স্থানান্তরিত হওয়া, পরীক্ষাভীতিসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ে কিংবা স্কুলে যায় না। এরপর ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলা হয়। অভিভাবকদের বুঝিয়ে বাচ্চাদের শিক্ষাকেন্দ্রে আনা হয়। প্রতিটি কেন্দ্রে দুই শিফটে প্রায় ৯০ জন বাচ্চাকে ভর্তি করানো হয়। ৪টি কেন্দ্রে ৮ জন শিক্ষক রয়েছে, এরমধ্যে ৬ জন নারী ও ২ জন পুরুষ। দৈনিক সকালে তিন ঘণ্টা ও বিকালে তিন ঘন্টা করে মোট ৬ ঘন্টা শিশুদের শেখানো হয়। এখানে শিশুদের শিক্ষাটা তার জীবনে স্থায়ী হয়। ’ এছাড়া বিপদজনক কাজে নিয়োজিত বিশেষ করে এতিম, পিছিয়ে পড়া ও ঝরেপড়া শিশুদের কাছে শিশুকেন্দ্রগুলো আদর্শ বিদ্যাপীঠ হিসেবে গড়ে উঠছে বলে মনে করেন তিনি।
মথুরাপুর শিশু সুরক্ষা কমিটির সভাপতি আলহাজ্জ্ব মোঃ নূর ইসলাম বলেন, ‘সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই আমরা বিদ্যালয়টি পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছি। আমরা অনেক স্বপ্নের মাঝে এলাকার প্রতিটি শিশুর হৃদয়ে শিক্ষার আলো জ্বেলে দেওয়ার স্বপ্নও দেখি। ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত ঝরেপড়া শিক্ষাবিমুখ শিশুদের কাছে এখন আদর্শ শিক্ষার বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে শিশুকেন্দ্রটি। উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের প্রকল্প শেষ হয়ে গেলেও আমাদের শিশুদের জন্য এই শিখন কেন্দ্রটি চালু রাখতে হবে। প্রয়োজনে আমরা গ্রামবাসী মিলে চাঁদা দিয়ে শিশু শিখন কেন্দ্রটি স্থায়ীভাবে চালু রাখবো।’
শ্যামনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ সোহাগ হোসেন জানান, মূলত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত স্কুল বহির্ভূত শিশুদের শিক্ষার মূল স্রোতে আনার জন্যই এ ব্যবস্থা। এটি দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া উপকূলীয় এলাকায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্জ্ব আবুল কাশেম মোড়ল বলেন, উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের এই কার্যক্রম উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। উক্ত শিখন কেন্দ্রের কার্যক্রমের নিয়মিত খোঁজখবর রাখা হয়। স্কুলটি যাতে স্থায়ীরূপ পায় সেজন্য সার্বিক সহযোগিতা করা হবে বলে জানান তিনি।


Top