আজ || সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
শিরোনাম :
 


তালায় ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে সরকারি চাকুরি পাওয়া দু’ভাই বরখাস্ত!

অবশেষে সাতক্ষীরার তালায় ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকুরিপ্রাপ্ত দু’সহোদরকে তাদের স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্ত করেছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস। অভিযুক্ত দুই সহোদার হলেন তালার আসাননগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রতাপ কুমার সাহা ও একই উপজেলার সরুলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বীরেন্দ্র নাথ সাহা। তারা তালা উপজেলার ধানদিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণনগর গ্রামের ললিত মোহন সাহার পুত্র। এরমধ্যে বীরেন্দ্র নাথ সাহা ২০০৮ সালে এবং প্রতাপ কুমার সাহা ২০০৯ সালে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
গত ১৯ জুন’২৩ তারিখে সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হোসনে ইয়াসমিন করিমী স্বাক্ষরিত ৩৮.০১.৮৭০০.০০০.০৪.০০৪.২০-১২৩৩ নং স্মারকের মাধ্যমে এ আদেশ প্রদান করা হয়। এতে বলা হয়, তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ এর ৪ (৩) (ঘ) ধারা অনুযায়ী অসদাচরণ ও দুর্নীতির আওতাভুক্ত অপরাধের কারণে তাদেরকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের ৪৮.০০.০০০০.০০.৩.৯৯.০০১.১৭.২০ নং স্মারক ও ৩১ জুলাই ২০২১ তারিখের পত্রে মতামত প্রদান করে যে, মুক্তিযোদ্ধা দাবীদার ললিত মোহন সাহার নামে দাখিলকৃত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাময়িক সনদ (যার নং ১৪৮৬০, তারিখ- ১৯/০৩/২০০৩) সঠিক নয়। এতে মুক্তিযুদ্ধের কোন স্বীকৃতি প্রমাণক পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়।
এর আগে ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দাখিল করে সহকারী প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলায় শুনানীতে সন্তোষজনক জবাব দাখিল করতে না পারায় শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
তালা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (প্রাথমিক) গাজী সাইফুল ইসলাম বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হোসনে ইয়াসমিন করিমী জানান, ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকুরিপ্রাপ্তর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বীরেন্দ্র নাথ সাহা ও তার ভাই প্রতাপ কুমার সাহাকে স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, তালা উপজেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের মৃত বসন্ত সাহার ছেলে মৃত লোলিত মোহন সাহা জীবদ্দশায় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবী করে একাধিক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রস্তুত করেন। যার একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাময়িক সনদপত্র, যার স্মারক নং-মুবিম/সা/খুলনা/প্র-৩/৪৫/২০০২/৩৯০, তারিখ-১৯-০৪-২০০৩। যার সার্টিফিকেট নং-১৪৮৬০। এর অন্তত ৬ বছর পর ২০০৯ সালের ১৫ মে’ যুদ্ধকালীন খুলনা বিভাগের লেঃ অবসরপ্রাপ্ত গাজী রহমতুল্লাহ দাদুর কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ করেন। ২০১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন ললিত মোহন সাহা। এরপর তার মৃত্যুর ৫ বছর পর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে আতাউল গনী ওসমানী স্বাক্ষরিত দেশরক্ষা বিভাগের স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র, একই বছরের ৪ এপ্রিল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তালা উপজেলা সংসদের কমান্ডার মফিজ উদ্দিনের নিকট থেকে তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়নপত্র, দু’দিন পর ৬ এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলা ইউনিট কমান্ডার মোশারফ হোসেন (মশু), একই বছরের ১৫ জুলাই ধানদিয়া ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও দক্ষিণ শারসা গ্রামের মৃত ফকির আহাম্মেদ গাজীর ছেলে মোঃ তবিবর রহমানের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যয়নপত্র গ্রহণ করেন।
এর মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ তবিবর রহমান প্রত্যয়ন দেয়ার পর জানতে পারেন যে, ভূয়া তথ্য দিয়ে ললিত মোহন সাহার ছেলেরা তাকে বিভিন্ন জাল, তঞ্চকী সনদসহ ভূয়া কাগজপত্র দেখিয়ে তার কাছ থেকে প্রত্যয়নটি নিয়েছে। মূলত এসব সনদে তার দু’ছেলে বীরেন্দ্র নাথ সাহা ২০০৮ সালে ও প্রতাপ কুমার সাহা ২০০৯ সালে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বিষয়টি জানতে পেরে তবিবুর রহমান ললিতের মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট ও তার দেওয়া প্রত্যয়নপত্রটি নিয়ে সাতক্ষীরা আমলী আদালতে প্রতাপ কুমার সাহা ও তার ভাই বীরেন্দ্র নাথ সাহার বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। যার নং সিআর-১৯৬/২০(পাট), ধারা: ৪৬৫/৪৬৮/৪৭১/৪১৭ ও ১১৪ দঃবিঃ।
আদালত অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পিবিআই সাতক্ষীরাকে নির্দেশ প্রদান করেন। এসআই সৈয়দ রবিউল আলম পলাশ দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর গত ২০/৪/২১ তারিখে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। যেখানে ১নং বিবাদী প্রতাপ কুমার সাহা ও ২ নং বিবাদী বীরেন্দ্র নাথ সাহা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় দাখিলকৃত তাদের পিতা ললিত মোহন সাহার নামে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং-মুবিস/সা/খুলনা/প্র-৩/৪৫/২০০২/৩৯০, তারিখ-১৯/০৪/২০০৩ মূলে ১৪৮৬০ নং ক্রমিকের সাময়িক সনদপত্রটি মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় হতে যাচাই করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ সচিব (সনদ) ডাঃ দুলাল কৃষ্ণ রায় স্বাক্ষরিত স্মারক নং ৪৮.০০.০০০০.০০৩.৫০.০৩০.১৮.৬১ তারিখ-২৩/০২/২০২১ এর মাধ্যমে জানানো হয় সাময়িক সনদপত্রটি সঠিক নয়। এছাড়া তারা জাল সনদকে আসল সনদ হিসেবে ব্যবহার করে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে অদ্যবধি সরকারি তহবিলের অর্থ গ্রহণ করায় তাদের বিরুদ্ধে দি পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৪৬৫/৪৬৮/৪৭১/৪২০ ধারার অপরাধ পাওয়া যায় বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনে।
এদিকে আদালতের ১৯৬/২০ মামলায় নিজেদের নির্দোষ প্রমাণে আসামী প্রতাপ কুমার সাহা ও বীরেন্দ্র নাথ সাহা গত ১৩/৪/২০২১ তারিখে সাতক্ষীরা বিজ্ঞ নোটারী পাবলিকের কার্যালয় থেকে এফিডেভিটের মাধ্যমে একটি অঙ্গীকার নামা প্রস্তুত করেন। যেখানে তারা বাদীর কাছ থেকে নেয়া প্রত্যয়নপত্র বাদীর অনুকূলে ফেরৎ প্রদানপূর্বক উল্লেখ করেন যে, ইতোপূর্বে তারা কোথাও প্রত্যায়নটি ব্যাবহার করেননি এমনকি ভবিষ্যতেও করবেন না। এছাড়া ঐ অঙ্গীকার নামায় তারা আরো উল্লেখ করেন যে, ওই প্রত্যয়ন ব্যতীত মুক্তিযোদ্ধা সংক্রান্ত কোন কাগজপত্র, সনদ তারা গ্রহণ করেননি। এর আগে পিতা ললিত মোহন সাহার মৃত্যুর ৩ বছর পর তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত করতে তার বড় ছেলে জোগেশ চন্দ্র সাহা গত ২৮/১০/২০১৩ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে অনলাইনে আবেদন করেন। যার প্রেক্ষিতে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক বিষয়টি গত ১/১০/২০১৫ তারিখে তালা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটিকে প্রেরণ করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা তবিবুর রহমান গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি মৃত ললিত মোহন সাহাকে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই তালিকা থেকে বাদ দিতে ও তালিকায় অন্তর্ভুক্তি না করতে তালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিব, মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি তালাসহ বিভিন্ন দপ্তরে পৃথক পৃথক আবেদন করেন।
দাদু ললিত মোহনকে মুক্তিযোদ্ধা দেখিয়ে ভুয়া সনদে বাবা-কাকাদের বিভিন্ন সরকারি চাকরি গ্রহণের জারী-জুরি ফাঁস হওয়ায় সর্বশেষ যাচাই-বাছাই কার্যক্রমকে প্রভাবিত ও এরআগে উত্থাপিত জাল সনদপত্রের সাথে সঙ্গতি রেখে চূড়ান্ত সনদপত্র সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন মহলে ব্যাপক দৌড়-ঝাঁপ শুরু করে ললিতের পৌত্র সুমন সাহাসহ স্বজনরা। এমনকি কথিত মুক্তিযোদ্ধা ললিতের তঞ্চকতাপূর্ণ সার্টিফিকেট’র তথ্য ফাঁস হওয়ায় অনলাইন আবেদন ঠিক রেখে নতুন করে সার্টিফিকেট প্রস্তুত করতে পরিবারের পক্ষে বিভিন্ন মহলে ঝাঁপের পর সর্বশেষ যাচাই-বাছাই তালিকায় নাম সম্পৃক্ত করতে উঠে-পড়ে লাগে। সর্বশেষ কমিটির একটি পক্ষকে ম্যানেজ করে দ্বিধা বিভক্ত তালিকায় নাম সম্পৃক্ত করতে সক্ষম হলেও শেষ রক্ষা হয়নি তাদের।

 


Top