আজ || সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
শিরোনাম :
 


অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সাতক্ষীরা আহ্ছানিয়া মিশন নিয়ে চলছে পরিকল্পিত চক্রান্ত

সাতক্ষীরা আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিকল্পিতভাবে ব্যাহত করা হচ্ছে। একটি গোষ্টি মিশনকে নিয়ে তাদের বানিজ্য বন্ধ হওয়ায় বর্তমান কমিটির বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। সাতক্ষীরা আহছানিয়া মিশনের সার্বিক বিষয় অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র.) ১৯৪৮ সালে সাতক্ষীরায় আহ্ছানিয়া মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৪ সালে মিশনের জন্য সাধারণ সম্পাদকের নামে ৪২ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার মধ্যে ৩৪ শতাংশ বর্তমানে মিশনের দখলে আছে। সাতক্ষীরা আহ্্ছানিয়া মিশনের জন্য পীর কেবলা নিজে ১৯৬২ সালে গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। গঠনতন্ত্রে তিনি ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, গরীবদের জন্য বিনামূল্যে ফ্রি চিকিৎসা সেবা, গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে বৃত্তি প্রদান, সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদ্যাপন করা, সাপ্তাহিক মিলাদ শরীফ ও মাসিক গেরুই শরীফ উদ্যাপন, ধর্মীয় পুস্তকাদি প্রকাশ করা, ধর্মীয় বই ও পুস্তিকা বিতরণ করা, দাখিল মাদ্রাসা, দারুল কোরান এবং হেফজখানা স্থাপন, এতিমখানা স্থাপন, হেফজখানা ও দারুল কোরান মাদ্রাসার গরীব ও এতিম ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন। এছাড়া পীর কেবলা ‘আমার রচনাবলী’র ১১তম খন্ডে গেস্ট হাউজ নির্মাণের কথা উল্লেখ করেছেন।
তাঁর এসব উদ্দেশ্য দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমান কার্যনির্বাহী কমিটি দায়িত্বে আসার পর কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের দিকনির্দেশনায় পীর কেবলার আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু বর্তমান কার্যনিবাহী কমিটির নেতৃবৃন্দকে পদে পদে বাঁধাগ্রস্ত ও হয়রানি করা হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা আহ্্ছানিয়া মিশনের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভার সিদ্ধান্তে আবু শোয়েব এবেল মিশনের চারতলা বিশিষ্ট মাল্টি কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো, সেখানে দ্বিতল বিশিষ্ট (১ হাজার ৬৬১ দশমিক ৪৯ স্কয়ার ফুট) ৩টি বৃহৎ দোকান ঘর নিয়ে সেখানে নিজের ব্যবসা করা।
কিন্তু শুরু থেকে নির্মাণ কাজে ব্যাপক, অনিয়ম ও দূর্ণীতি দেখা দিলে মিশনের ৪৬ জন সদস্য ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ করেন। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের সভাপতিও জেলা প্রশাসকের নিকট আলাদা একটি পত্র দেন।
এরমধ্যে ২০১৮ সালের ৫ মে মিশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল-আলহাজ্জ কাজী মনিরুজ্জামান মুকুল, আলহাজ্জ গোলাম মোস্তফা, আলহাজ্জ মামুনার রশীদ এর নেতৃত্বাধিন প্যানেলের ২৩ জন সদস্য ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেন। এর প্রায় এক মাস পর ২০১৮ সালের ৩ জুন তাদের দায়িত্ব দেন।
অন্যদের দোকান প্রস্তুত না করে, মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু না করে মিশনের অংশ সম্পূর্ণ ফাঁকা রেখে তড়িঘড়ি করে নিজের ব্যবসার জন্য বরাদ্দ নেয়া অংশে দুইতলা বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে প্রেসের মেশিনপত্র কিনে নিজের ব্যবসা শুরু করেন আবু শোয়েব এবেল।
এ অবস্থায় আবু শোয়েব এবেল সাদা কাগজে ১ কোটি ৪৮ লাখ ৮২ হাজার ৩০৪ টাকা এ পর্যন্ত নির্মাণ খরচ হয়েছে দাবি করে একটি হিসাব দেন। যার বিল-ভাউচার আজও কমিটির কাছে দেয়া হয়নি। তার দাখিলকৃত খরচের সঠিকতা নিরুপন করতে মিশনের সভাপতি ও তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো: ইফতেখার হোসেন সাতক্ষীরা এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলীর মাধ্যমে উপ-সহকারি প্রকৌশলী মো. আবু সিদ্দিককে দিয়ে খরচ নির্ধারনের জন্য দায়িত্ব দেন। তিনি ২০১৮ সালের ১ আগস্ট একটি লিখিত প্রতিবেদন দেন। সেখানে তিনি ভবনের নির্মাণ ব্যয় ঠিকাদারী প্রফিটসহ সর্বোচ্চ খরচ ১ কোটি ২৭ লাখ ৯ হাজার ৩৮১ টাকা হয়েছে মর্মে উল্লেখ করেন। এরপর আবু শোয়েব এবেল মিশনের বর্তমান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তাদের সাথে বিরোধ শুরু করেন। আবু শোয়েব এবেল সরকারি প্রকৌশলীর রিপোর্ট না মেনে তার সাদা কাগজে দাখিলকৃত টাকা দাবি করেন। কয়েক দফা আলোচনার পর ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর জেলা প্রশাসকের বাংলোয় মিশনের কর্মকর্তা ও আবু শোয়েব এবেলের উপস্থিতিতে জেলা প্রশাসক স্বহস্তে ১ কোটি ৪১ লাখ টাকায় রফা করেন। সেখানে তিনি আবু শোয়েব এবেলের অনুকূলে থাকা দ্বিতল বিশিষ্ট দোকানের পজেশন মূল্য বাবদ মাত্র ৫০ লাখ টাকা ১২ হাজার টাকায় র্নিধারণ করেন। সেটি তিনি হাসিমুখে মেনে নেন। এবং ওই দিন তিন লাখ টাকার চেক গ্রহণ করেন। এভাবে তিনি মিশন থেকে ৯০ লাখ ৮০ হাজার নগদ টাকা গ্রহণ করেছেন। এর বাইরেও বিভিন্ন সময়ে মিশনের কাছ থেকে ঋণও নিয়েছেন। যা আজও পরিশোধ করেননি।
কিন্তু মিশন কর্তৃপক্ষ বিরোধ নিষ্পত্তি ও শান্তির স্বার্থে সভাপতি আবু শোয়েব এবেলের দোতলা বিশিষ্ট দোকানের মূল্যমান মাত্র ৫০ লাখ ১২ হাজার টাকায় মেনে নেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় আবু শোয়েব এবেল ৫/১০/২০১৮ তারিখের মধ্যে মিশনের সাথে চুক্তি সম্পাদন করবেন। কিন্তু অদ্যাবধি তিনি নানা অজুহাতে তালবাহানা করে কোনো চুক্তি করেননি। এমনকি আজ পর্যন্ত তার পজেশনে রাখা দোকানগুলি দিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করলেও কোনো ভাড়া দেননি।
ভাড়া পরিশোধের জন্য তাকে কয়েক দফা নোটিশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি সেই নোটিশ অগ্রাহ্য করে অদ্যবধি ভাড়া না দিয়ে, চুক্তি না করে উল্টো মিশন কর্তৃপক্ষের নামে গত ২৭ অক্টোবর সাতক্ষীরা যুগ্ম জেলা জজ-১নং আদালতে (দেওয়ানী-১৫৬/২০ ও মানিস্যুট ৮/২০২০নং) ২টি মিথ্যা, বানোয়াট গল্প তৈরি করে মামলা দায়ের করেছেন।
উল্লেখ্য, ভবনের নকশায় কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড রাখা হয়নি। কাজ শুরুর আগে পৌরসভা কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে নকশা অনুমোদন করেননি। সামনে রাখা হয়নি কোনো পার্কিংয়ের জায়গা। পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থাও রাখা হয়নি ভবনটিতে।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, সরকারি গেজেট ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নীতিমালা অনুযায়ি সাতক্ষীরা আহ্্ছানিয়া মিশন পরিচালিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হওয়ার কথা মিশনের সভাপতি বা তার মনোনিত ব্যক্তির। যেটি ১৯৮৫ সাল থেকে সেই নিয়মেই পরিচালিত হচ্ছিল। কিন্তু মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল এর নেতৃত্বাধিন কার্যনির্বাহী কমিটি নিরঙ্কুশভাবে বিজয় লাভের পরও মাদ্রাসা ও এতিমখানা আজ পর্যন্ত মিশনের নিকট বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। মিশনের নিজস্ব মালিকানাধিন জমিতে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা, এতিমখানা, লিল্লাহ বোডিং ও হেফজখানা বর্তমান কমিটির হাতে বুঝিয়ে না দিয়ে টিএন্ডটির অবসরপ্রাপ্ত সাবেক কর্মচারি তহিদুর রহমান ডাবলুসহ কতিপয় সুবিধাবাদী ব্যক্তি জোরপূর্বক দখলে রেখেছে। এর মুল কারন আহ্্ছানিয়া মিশন মাদ্রাসায় শিক্ষক ও কর্মচারি নিয়োগে অর্ধকোটি টাকার বাণিজ্য।
এমন অবস্থায় সাতক্ষীরা আহ্ছানিয়া মিশনের কার্যনির্বাহী কমিটির মেয়াদ গত ৩ জুন শেষ হয়। মেয়াদ শেষের আগে বিষয়টি মিশনের সভাপতি ও জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হয়। বৈশ্বিক মহামারী করোনা পরিস্থিতির কারনে দেশে তখন সাধারণ ছুটি। নিষিদ্ধ সব ধরনের সভা-সমাবেশ। মসজিদে পাঁচজনের বেশি মুসুল্লীর উপস্থিতি নিষেধ। তখন গঠনতন্ত্রের আলোকে কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের সভাপতি ও সাতক্ষীরা-৩ আসনের সংসদ সদস্য ডা. আ ফ ম রুহুল হক, সাতক্ষীরা-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ও কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহমেদ সাহেবের সাথে আলোচনাপূর্বক গত নির্বাচনে পরাজিত ৬ জনসহ নতুন ৮জনকে নিয়ে কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করেন। বিষয়টি স্থানীয়, জাতীয় ও বিভিন্ন অনলাইন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়।
মিশনের একাধিক কর্মকর্তা ও সদস্য জানান, পূর্বের কমিটি মসজিদের নূন্যতম কোনো অবকাঠামো করে যাননি। তারা গত ১৮/০১/২০১৮ তারিখের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেন, দোতলার পুরো অংশ দোকানঘর ভাড়া দিয়ে তিনতলায় মসজিদ স্থাপন করা হবে। মিশনের সদস্যদের দাবীর প্রেক্ষিতে বর্তমান কমিটি দোতলায় মসজিদ স্থাপন করেন।
তৎকালীন জেলা প্রশাসক ২৬/০৫/২০১৮ তারিখে সাতক্ষীরা সার্কিট হাউজে উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে সাতক্ষীরা আলিয়া মাদ্রাসার প্রধান মুফতি আক্তারুজ্জামান সাহেবসহ বিভিন্ন আলেমগণকে নিয়ে এক সভা করেন। সেখানে আলেমগন বলেন, মসজিদ ভবন বহুতল স্থাপনের শর্ত হচ্ছে মসজিদের ওপর মসজিদই স্থাপিত হবে। এরপর জেলা প্রশাসক ০২/০৭/২০১৮ তারিখে গঠনতন্ত্রে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা মাথায় রেখে একটি নকশা তৈরি করে দেন। সেই নকশা মোতাবেক কমিটি মিশনের নিজস্ব অর্থায়নে এক বছর আগে দ্বিতীয় তলায় ২ হাজার ৩৭৬ বর্গফুট আয়তন বিশিষ্ট মসজিদ স্থাপন করেছেন এবং এই মসজিদের সমপরিমাণ জায়গা তৃতীয় তলা ও চতুর্থ তলায় বরাদ্দ রেখেছেন। যার সর্বমোট আয়তন হবে ৭ হাজার ১২১ বর্গফুট। ইতিমধ্যে তৃতীয় তলায়ও মসজিদের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। এ নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করে ওই মহলটি ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছেন বলে তারা জানান।
সাতক্ষীরা আহ্ছানিয়া মিশন এর সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল এসব প্রসঙ্গে জানান, মুলত: খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (র:) এঁর মিশন প্রতিষ্ঠার লক্ষ উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করতে একটি বিশেষ মহল পরিকল্পিতভাবে চক্রান্ত করছে। এনিয়ে সকল মিশন প্রেমিক তথা সাতক্ষীরাবাসিকে সজাগ থাকতে অনুরোধ জানিয়েছেন।


Top