আজ || সোমবার, ২০ মে ২০২৪
শিরোনাম :
 


ভিটামিন ডি কি আসলেই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করে?

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ছড়াচ্ছে এর চিকিৎসা নিয়ে নানা রকম ভুয়া তথ্য।

কিছু ভুয়া তথ্য আছে যা একেবারে সরাসরি ভুল বা মিথ্যা। কিন্তু কিছু তথ্য আছে- যা খানিকটা সত্য এমন কিছু ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে ।

যাই হোক না কেন, ভুয়া তথ্যের মোকাবিলা করা সবসময়ই কঠিন।

কোভিড সংক্রমণে ভিটামিন ডি কেন

কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার জন্য এ পর্যন্ত বহু রকম উপায় বাতলানো হয়েছে।

হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন, আইভারমেকটিন, ভিটামিন-ডি- এগুলোর প্রতিটি নিয়েই গবেষণা হয়েছে বা এখনো হচ্ছে।

বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রক্রিয়ায় এটা স্বাভাবিক ঘটনা যে – প্রথমে মনে করা হয়, অমুক রোগের চিকিৎসায় অমুক ওষুধ কার্যকর হতে পারে। কিন্তু আরো গবেষণার পর দেখা যায় ফলাফল ভিন্ন।

কিন্তু অনলাইনে ব্যাপারটা ভয়াবহ চেহারা নেয়।

অনেক প্রাথমিক গবেষণা বা নিম্নমানের গবেষণার ফলও প্রেক্ষাপট বিবর্জিতভাবে ইন্টারনেটে শেয়ার হয়। এগুলো সৃষ্টি করে বিভ্রান্তি এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারের কাজে ব্যবহৃত হয় ।

ভিটামিন ডি কে কোভিড চিকিৎসা বা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে – এমন মনে করার সপক্ষে কিছু কারণ অবশ্যই আছে।
কারণ, ভিটামিন ডি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় একটা ভূমিকা পালন করে।

যুক্তরাজ্যে এখন শীতকালে সবাইকে ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করতে সুপারিশ করা হয়। যাদের দেহে এই ভিটামিনের ঘাটতি আছে, তাদের সারা বছর ধরেই এটা খেতে বলা হয়।

কিন্তু, উচ্চমাত্রায় ভিটামিন ডি খেলে কোন রোগ প্রতিরোধ করা বা তার চিকিৎসা সম্ভব – আজ পর্যন্ত কোন গবেষণাতেই এটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতীয়মান হয় নি।

অবশ্য তার মানে এটি নয় যে ভবিষ্যত কোন গবেষণায় এর কোন পরিবর্তন হবে না।

গবেষণায় কি দেখা গেছে

অনেকগুলো জরিপে দেখা গেছে যে ভিটামিন-ডি এবং কোভিড সংক্রমণের পরিণাম – এ দুয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে।

কিন্তু এগুলো হচ্ছে পর্যবেক্ষণ থেকে পাওয়া প্রমাণ। এর অর্থ হলো: এখানে কোভিড আক্রান্ত হবার পর ভিটামিন ডি ঘাটতি আছে এমন লোকদের ক্ষেত্রে কি ঘটেছে, তার সাথে উচ্চতর মাত্রার ভিটামিন ডি আছে এমন লোকদের কি ঘটেছে – তারই তুলনা করা হয়েছে।

কিন্তু এখানে রোগীদের ওপর অন্য যেসব প্রভাবক কাজ করেছে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি। এগুলো তাই সর্বোচ্চ স্তরের বা ‘গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড’ তথ্যপ্রমাণ নয়।

সেটা পেতে হলে অনেক বেশি নিয়ন্ত্রিত ট্রায়াল চালাতে হয়। যাতে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে চিকিৎসার যে ফল পাওয়া যাচ্ছে – তা ওই বিশেষ পদ্ধতি প্রয়োগের কারণেই হচ্ছে।

তবে এটা ঠিক যে পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক জরিপে দেখা যায়, কিছু গোষ্ঠীর মানুষদের ভিটামিন ডি ঘাটতি থাকার এবং কোভিডে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি। যেমন – যারা বয়স্ক মানুষ, যারা স্থূল, বা কৃষ্ণাঙ্গ বা দক্ষিণ এশিয়ান জনগোষ্ঠীর মানুষ যাদের ত্বকের রঙ অপেক্ষাকৃত কালো বা বাদামী।

এমন হতে পারে যে ভিটামিন ডি কম থাকাটাই এই জনগোষ্ঠীর করোনাভাইরাস সংক্রমণের বেশি ঝুঁকির কারণ। অথবা এর পেছনে কোন পরিবেশ বা স্বাস্থ্যগত কারণও থাকতে পারে।

ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থায় কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশিয়ান বংশোদ্ভূতদের সারা বছর ধরে ভিটামিন ডি খেতে বলা হয়।

কিন্তু ভিটামিন ডি’র ঘাটতির সাথে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কোন সম্পর্ক আছে কিনা তা শুধু যথাযথ গবেষণার পরই বলা সম্ভব।

বর্তমানে কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে এরকম একটি জরিপ চলছে।

স্পেনের কিছু জরিপ

বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপের প্রতি সম্প্রতি অনেকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়।

এতে আভাস দেয়া হয়, ভিটামিন ডি নেবার ফলে করোনাভাইরাস সংক্রমিতদের আইসিইউতে ভর্তি হবার প্রয়োজন ৮০ শতাংশ কমে গেছে, এবং কোভিডে মৃত্যু কমেছে ৬০ শতাংশ।

অনলাইনে এ জরিপটি ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়।

কিন্তু এ জরিপটি এখন অনলাইন থেকে তুলে নেয়া হয়েছে। ল্যানসেট সাময়িকী এ গবেষণাপত্রটির ব্যাপারে একটি তদন্তও শুরু করতে যাচ্ছে।

কিন্তু এই জরিপটি অনলাইনে যত প্রচার পেয়েছিল, এটি প্রত্যাহারের খবর ততটা পায়নি।

স্পেনের একজন জরুরি সেবা সংক্রান্ত ডাক্তার অরোরা বালুজা বার্সেলোনার জরিপটি রিভিউ করেছিলেন। তিনি বলছেন, “আইসিইউতে থাকা যেসব কোভিড রোগী মারা যায়, তাদের ক্ষেত্রে ভিটামিন ডির ঘাটতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু শুধু ভিটামিন-ডি সাপ্লিমেন্ট দিয়ে তাদের মৃত্যুর ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা সব সময়ই ব্যর্থ হয়েছে। “

ইন্টারনেটে প্রচারণা

অনলাইনে অনেকেই ভিটামিন ডি এর সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সম্পর্ককে একটি ডাক্তারি পরামর্শ হিসেবে ধরে নিয়েছেন।

অনলাইনে কিছু ফোরামে অনেকে আবার এটাকে বহুদূর পর্যন্ত নিয়ে গেছেন।

কেউ কেউ বলেছেন, অনেক দেশের সরকারই ভিটামিন ডি’র কার্যকারিতার কথা ‘নামমাত্র’ উল্লেখ করছে এবং তারা জোর দিচ্ছে ভ্যাকসিন এবং সংক্রমণের ট্র্যাকিংয়ের ওপর। তাদের মতে “এই উপেক্ষার কারণ হলো – বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বড় বড় ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নেয়।”

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে ডেক্সামেথাসোনের মত সস্তা ও কার্যকর চিকিৎসা যখন প্রমাণিত হয়েছে – তখন সরকারগুলো একে ঠিকই গ্রহণ করেছে।

তা ছাড়া ভিটামিন বিক্রি নিজেই একটি কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা।

ভিটামিন ডি খেলে ক্ষতি কী

অনলাইনে যারা আদর্শগতভাবে টিকা বিরোধী- তারা অনেকে নানা রকমের ‘প্রাকৃতিক’ চিকিৎসা, বিকল্প ওষুধ, বা ভেষজ চিকিৎসা ধর্ম – ইত্যাদি নানারকম অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত।

ভিটামিন ডি এর ব্যাপারটা তাদের বিশ্বাসের সাথে মিলে যায়। তারা লোককে বলতে চান যে “টিকা নেবার দরকার নেই, ভিটামিন ডি নিলেই যথেষ্ট।”

ভিটামিন ডি তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিমুক্ত – তাই ভুয়া তথ্য হিসেবেও একে খুব একটা ক্ষতিকর বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় না।

কিন্তু কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ভ্যান ডার লিন্ডেন বলছেন, “বিপদটা হয় তখনই যখন লোকে ধরে নেয় যে এটা একটা জাদুকরী চিকিৎসা, এবং ভ্যাকসিন, মাস্ক বা সামাজিক দূরত্ব রক্ষা না করে তার বদলে ভিটামিন ডি খেলেই যথেষ্ট”।


Top