আজ || শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪
শিরোনাম :
  তালায় আমার সংবাদ পত্রিকা ১যুগে পদার্পণে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী পালিত       তালা বাজার বণিক সমিতির সহ-সভাপতি রানাকে সাময়িক বহিষ্কার       বাজারে এলো নতুন প্রযুক্তির হোন্ডা এসপি ১৬০ বানিজ্য সংবাদ ::       তালায় বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্টের সমাপনী       তালায় মুজিব কিল্লার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন       তালায় আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত আনন্দ-উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত       পঞ্চম দিনের মতো খুলনা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে চলছে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি       তেলবাজির তেলেসমাতি        তালায় যুব রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কমিটি গঠন       সাতক্ষীরা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে কর্মবিরতি পালন    
 


সাতক্ষীরায় বিলুপ্তির পথে টালী শিল্প

অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ও মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে বিলুপ্তির পথে সাতক্ষীরার সম্ভাবনাময়ী টালী শিল্প। এক সময়ের সাতক্ষীরার অর্থনীতির এক নম্বর এই খাত আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পেশা হারিয়ে বিপাকে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট মালিক ও শ্রমিকরা।

দেশের প্রায় সব ক্ষেত্রেই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও টালী কারখানা আধুনিক না হওয়া, উৎপাদন খরচ বাড়লেও দাম না বাড়া, সরকারের সুদৃষ্টির অভাব ও সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়া এই শিল্প ধ্বংসের অন্যতম কারণ। তবে এখনো হাতে গোনা কয়েকজন কারখানা মালিক এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মুরারীকাটি ও শ্রীপতিপুর এলাকায় প্রথমে টালী উৎপাদন শুরু হয়। পরে আশপাশের আরও কয়েকটি গ্রামে পর্যায়ক্রমে ৩৫ থেকে ৪০টি কারখানা গড়ে উঠলেও এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ থেকে ১০টিতে।

স্থানীয় এসব টালী কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০০ সালের দিকে কলারোয়ায় টালী নির্মাণ শুরু হয়। সে সময় রাফাইলো আলদো নামের এক ইটালীর ব্যবসায়ী আসেন বাংলাদেশে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তিনি নারায়ণগঞ্জে টালী তৈরির কাজ শুরু করেন। কিন্তু সেখানকার মাটি টালী তৈরি উপযুক্ত না হওয়ায় তিনি দেশে ফিরে যান।

রাফাইলো আলদো ফিরে গেলেও তার বাংলাদেশি প্রতিনিধি রুহুল আমিন দেশের বিভিন্ন স্থানে পোড়া মাটির টালী তৈরির জন্য মাটি খুঁজতে থাকেন। এক পর্যায়ে তিনি সাতক্ষীরার কলারোয়ায় এসে পেয়ে যান টালী তৈরির উপযোগী মাটির সন্ধান। তখন কলারোয়ায় শুধুমাত্র ছাউনির কাজে ব্যবহৃত টালী (স্থানীয় নাম ‘খোলা’) তৈরি করা হত। মূলত তিনি এই টালী দেখেই বুঝতে পারেন এখানকার মাটি দিয়েই রপ্তানিযোগ্য টালী তৈরি সম্ভব।

তাই ‘কারার এক্সপোর্ট ইমপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের মালিক রুহুল আমিন কলারোয়ার পালদের পোড়া মাটি দিয়ে তৈরি রপ্তানিযোগ্য টালীর সম্ভাবনার গল্প শোনান। সেই থেকে শুরু হয় বিভিন্ন নকশা আর ডিজাইনের টালী তৈরি। প্রথম দিকে এখানকার টালী ইতালিতে রপ্তানি হত। এ কারণে কলারোয়ার এ এলাকা ধীরে-ধীরে ‘ইতালিনগর’ এবং পোড়া মাটির টালী ‘ই-টালী’ নামে পরিচিত হতে থাকে।

প্রথম দিকে বাংলাদেশে এই টালী শুধুমাত্র ঘরের ছাউনিতে ব্যবহার করা হলেও ইতালীতে এই টালী ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ছাদের উপর ছাড়াও ঘরের মেঝে ও দেয়ালেও ব্যাবহার করা হতো। বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধনে ব্যবহৃত এই ‘ই-টালী’ অল্পদিনেই নজর কাড়ে জার্মান, দুবাই, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের। জাহাজে করে রপ্তানি শুরু হয় এসব দেশে। মোংলা বন্দর দিয়ে কলারোয়ার মাটির তৈরি টালী রপ্তানি হতে থাকে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে।

তবে টালী রপ্তানির সেই যুগ এখন শুধুই ইতিহাস। আগে যেখানে বছরে ৪শ কন্টেইনার টালী বিদেশে রপ্তানি করা হতো এখন তা ২শ কন্টেনারেরও কমে নেমে এসেছে। কমে এসেছে টালীর দামও। মধ্যসত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে ছোট টালী প্রতি পিস সাড়ে পাঁচ টাকা থেকে ছয় টাকায় বিক্রি হচ্ছে যার উৎপাদন খরচও প্রতি পিস সাড়ে পাঁচ টাকা। অন্যদিকে বড় টালী প্রতি পিস বিক্রি হচ্ছে ৩৫টাকা দরে যা প্রতি পিস উৎপাদনে প্রায় ৩৫টাকা খরচ। আর অসাধু ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারখানা মালিকরা এই টালী ব্যবসা থেকে ঝরে পড়তে শুরু করে।

টালী রপ্তানির দুই মাস পর টাকা হাতে পান কারখানা মালিকরা। যথা সময়ে টাকা না পাওয়া এই শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর আরও একটি বড় কারণ। তার ওপর আবার মধ্যসত্বভোগীদের কারণে অনেকে মাসের পর মাস কেটে গেলেও টাকা পান না।

এসব ব্যাপারে কলারোয়ার মুরারীকাটি এলাকার একটি টালী কারখানার মালিক শ্রীকান্তপাল বলেন, আগে যেভাবে ব্যবসা চলতো এখন সেভাবে চলে না। আগে ৪শ কন্টেইনার মাল যেত এখন দুই থেকে আড়াইশ কন্টেইনার যায়। আগে আমার কারখানায় ৪০ জনের বেশি শ্রমিক কাজ করতো এখন মাত্র ১০জন কাজ করে। কোনো রকমে ডাল-ভাত খেয়ে আমরা বেঁচে আছি।

কাজ হারিয়ে নতুন কাজের সন্ধানে থাকা টালী শ্রমিক বদরউদ্দিন বলেন, আগে আমরা ৩০-৩৫জন এই কারখানায় কাজ করতাম। এখন কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ নেই নতুন কাজ খুঁজছি। পরিবার পরিজন নিয়ে খুব ভালো নেই।

কারখানা মালিক মনিরুল ইসলাম বলেন, আগে ব্যবসা ভালোই চলতো। এখন আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষ ঘরের ছাউনিতে টিন ও সিমেন্ট শিট ব্যবহার করছে। কিন্তু টিনের চেয়ে টালী কিন্তু অনেক ভালো। ঘরের ছাউনিতে টালী ব্যবহার করলে গরমের সময় ঘর ঠান্ডা আর শীতের সময় গরম থাকে তবুও মানুষ এখন টালীর ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, টালী শ্রমিকরা সহজে অন্য কোথাও কাজ খুঁজে নিতে পারছে কিন্তু আমরা তা পারছিনা। দিনটা কষ্টেই যাচ্ছে।

সম্ভাবনাময়ী টালী শিল্পের এই দুর্দিনে খুব হতাশ কলারোয়া টালী কারখানা মালিক ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি ও কলারোয়া ক্লে টাইলস-এর মালিক গোষ্ট চন্দ্র পাল। প্রথমে তিনি এ বিষয়ে সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতেই রাজি হননি। পরে অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই জানালেন ব্যবসার এমন দুঃসময়েও স্থানীয় একজন পৌর কাউন্সিলর সিন্ডিকেট গড়ে তুলে ব্যবসার পরিবেশ আরও নষ্ট করছেন।

স্থানীয় সংবাদকর্মী ফারুক হোসেন রাজ বলেন, কলারোয়ার টালী শিল্প এ উপজেলার ঐতিহ্য ও পরিচিতির একটা বিরাট অংশ। কিন্তু এটি এখন বিলুপ্তির পথে। এই শিল্পকে রক্ষা করা দরকার। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন এই শিল্পকে রক্ষ করতে যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার অতিদ্রুত সেসব পদক্ষেপ নেওয়া হোক।

টালী শিল্পের এই দুর্দিনের পেছনে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা দায়ী উল্লেখ করে কলারোয়া উপজেলা চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম লাল্টু বলেন, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে সম্ভাবনাময়ী এই শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। আর মধ্যসত্বভোগীরা তৃণমূলের কারখানা মালিকদের কাছ থেকে টালী নিয়ে রপ্তানি করলেও তাদেরকে ঠিকমতো টাকা পরিশোধ করেননি ফলে তারা এ ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়েছে। যারা এই শিল্পকে এক সময় সম্ভাবনার চূড়ান্ত শিখরে নিয়ে গিয়েছিলো তাদের অনেকেই আজ ঠিকমতো খাবার পায় না। আর মধ্যসত্বভোগীদের আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। এই সরকারের প্রধান গরিবের বন্ধু, কৃষকের বন্ধু এবং প্রান্তিক কুটির শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের বন্ধু। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাই কলারোয়ার সম্ভাবনাময়ী এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে স্বল্প সুদে অথবা বিনা সুদে কারখানা মালিকদের ঋণের ব্যবস্থা করা হোক। আর যারা সিন্ডিকেট গড়ে তুলে এই শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে তাদেরকে সরকারিভাবে প্রতিহত করা হোক।


Top